২২ এপ্রিল, ২০২০ ১০:২৮:১৫
রাজধানীর শ্যামলী এলাকার একটি বড় হাসপাতালে ১৪ এপ্রিল একজন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন ক্লোরেক্টাল সার্জারির জন্য। পরদিন সকালে এই রোগীর করোনা শনাক্তের পরীক্ষার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) অনুরোধ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আইইডিসিআর নমুনা সংগ্রহ করে। শল্যচিকিৎসার জন্য আসা এই রোগীর করোনা শনাক্ত হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই রোগীর করোনার কোনো উপসর্গ ছিল না। সন্দেহ থেকে আমরা পরীক্ষা করিয়েছিলাম।’ এরপর ওই হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ ১১ জনকে কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) পাঠায় কর্তৃপক্ষ।
এমন ঘটনার কথা শ্যামলীর ওই বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি আরও কিছু হাসপাতালে ঘটেছে বলে চিকিৎসকদের সূত্রগুলো জানিয়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদ ও গবেষকেরা বলছেন, উপসর্গহীন ব্যক্তিরাই সংক্রমণের বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের হাঁচি-কাশি থেকেও ভাইরাস ছড়াচ্ছে। কিন্তু পাশের মানুষটি তা জানেন না, কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও নেন না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কোভিড-১৯ শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এর সাধারণ উপসর্গ হচ্ছে জ্বর, কাশি, ঘন ঘন শ্বাসপ্রশ্বাস ও শ্বাসকষ্ট। রোগ মারাত্মক হলে নিউমোনিয়া দেখা দেয়। পাশাপাশি তীব্র শ্বাসজনিত সমস্যা তৈরি হয়। কিডনি কার্যকারিতা হারায়।
বিভিন্ন দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে ১৪ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত কোভিড-১৯-বিষয়ক হালনাগাদ কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, ৪০ শতাংশ রোগীর উপসর্গ থাকে মৃদু, ৪০ শতাংশ রোগীর থাকে মাঝারি লক্ষণ, যাঁদের নিউমোনিয়া হতে পারে। ১৫ শতাংশের রোগ তীব্র আকার ধারণ করে। বাকি ৫ শতাংশ জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে।
দেশে শুরু থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরীক্ষা করা হতো মূলত বিদেশফেরত ব্যক্তিদের। গত ২২ মার্চ রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগে করোনায় এক বাসিন্দার মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল না। বিদেশফেরত কারও সংস্পর্শে আসারও ইতিহাস ছিল না তাঁর। এরপর তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন, এমন ব্যক্তি খোঁজার (কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং) উদ্যোগ নেয় আইইডিসিআর। এরপর থেকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আরও অনেককে এভাবে পরীক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। তাঁদের সংখ্যা ৩ হাজার ১৭৬। তাঁদের ২৩ শতাংশ উপসর্গ ছিল না, অথচ পরীক্ষায় রোগ শনাক্ত হয়েছে।
আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘সাধারণভাবে এখন জ্বর, সঙ্গে কাশি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহ করা যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এসব উপসর্গ না থাকলেও মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত থাকতে পারে। বিভিন্ন জায়গা থেকে তা শোনা যাচ্ছে।’
একটি সূত্র বলছে, রাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের দোতলার আইসোলেশন ইউনিটে আইইডিসিআরের ছয়জন কর্মীসহ তাঁদের সংস্পর্শে আসা আরও তিনজন ভর্তি আছেন। তাঁদের কারোর করোনার কোনো উপসর্গ ছিল না। কিন্তু আইইডিসিআরের নমুনা পরীক্ষায় তাঁদের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছিল। সে কারণে প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোয়ারেন্টিনে ছিলেন।
এখন প্রশ্ন উঠেছে সমস্যাটির ব্যাপকতা নিয়ে। বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বা বিশেষ শারীরবৃত্তীয় কারণে অনেকের শরীরে সব রোগের উপসর্গ না-ও দেখা দিতে পারে। ভেতরে রোগ থাকে, কিন্তু বাইরে প্রকাশ পায় না। কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রেও তা সত্যি। উপসর্গহীন মানুষ সকলের সঙ্গে সকলের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা রোগ ছড়ায়। এখন করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে।’ একই কথা বলেছেন মীরজাদী সেব্রিনাসহ আরও একাধিক রোগতত্ত্ববিদ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘অ্যাসিম্পটোমেটিক’।
দেশে ৩ হাজার ১৭৬ জনের পরীক্ষায় দেখা গেছে, ২৩ শতাংশের উপসর্গ ছিল না, অথচ তাঁদের রোগ শনাক্ত হয়েছে।
ভারতের জনস্বাস্থ্যবিদ ও গবেষকেরা বলছেন, দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের ৮০ শতাংশ উপসর্গহীন। অর্থাৎ ভারতে ৮০ শতাংশ আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরেই হাঁচি-কাশি, সর্দি-জ্বর বা গলাব্যথার মতো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। ভারতের শীর্ষ গবেষণা সংগঠন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চের বিজ্ঞানী রামন আর গঙ্গাখেরকর দুই দিন আগে একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, এই রোগীদের খুঁজে বের করা বড় চ্যালেঞ্জ। গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, সম্প্রতি একটি নির্দিষ্ট সময়ে দিল্লিতে নমুনা পরীক্ষায় ১৮৬ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। তাঁদের কারোর কোনো উপসর্গ ছিল না।
চীন থেকে এই ভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। ৫৫ হাজারের বেশি রোগীর তথ্য নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীনের যৌথ মিশন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আক্রান্ত অনেকের মধ্যে রোগের কোনো লক্ষণ ছিল না। পৃথিবীর একাধিক দেশে এই প্রবণতা দেখা গেছে।
একটি প্রতিষ্ঠানের দৈবচয়নের (র্যানডম স্যাম্পলিং) ভিত্তিতে করা ছোট একটি জরিপে দেখা গেছে, শনাক্ত হওয়া ১২ জনের মধ্যে ২ জনের কোনো উপসর্গ ছিল না। অর্থাৎ ওই প্রতিষ্ঠানে উপসর্গহীন আক্রান্ত মানুষ প্রায় ১৭ শতাংশ। একটি প্রতিষ্ঠান দেশব্যাপী রোগতাত্ত্বিক জরিপের সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। সরকারি-বেসরকারি একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি তরফে এই পরিস্থিতি জানার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা বা অন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ নেই।
উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে আক্রান্তদের চারটি ভাগে ভাগ করা যায় বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আহমেদুল কবীর। প্রথমে আছে অ্যাসিম্পটোমেটিক বা উপসর্গহীন। দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে ‘প্রাক্-উপসর্গ’। এই পর্যায়টিকে সবচেয়ে মারাত্মক বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। এটি উপসর্গ দেখা দেওয়ার পূর্ববর্তী ৪৮ ঘণ্টায় আক্রান্ত ব্যক্তি বেশি ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষমতা রাখেন। এরপর উপসর্গকাল। আক্রান্ত ব্যক্তির এই সময় জ্বর, কাশি, ঘন ঘন শ্বাসপ্রশ্বাস ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এর পরের স্তরে নিউমোনিয়া দেখা দেয়। পাশাপাশি তীব্র শ্বাসজনিত সমস্যা তৈরি হয়। কিডনিসহ অন্য কিছু অঙ্গ কার্যকারিতা হারায়।
করণীয়
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শীর্ষ জনস্বাস্থ্যবিদ প্রথম আলোকে বলেছেন, রোগতাত্ত্বিক জরিপ করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এটি পরিস্থিতি জানার জন্য দরকার। এটা রোগনিয়ন্ত্রণের জন্যও দরকার। একাধিক গবেষণা ও জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, কোনো দেশে ৬৪ শতাংশ, কোনো দেশে ৩০ শতাংশ উপসর্গহীন সংক্রমিত ধরা পড়েছে। সেই পরিসংখ্যানসংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘আমরা যে মানুষকে ঘরে থাকতে বলছি, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলতে বলছি, তা সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর জন্যই।’ তিনি বলেন, বিপুলসংখ্যক মানুষকে পরীক্ষা করার সঙ্গে সামর্থ্যের বিষয়টি সম্পর্কিত। তা ছাড়া সহজলভ্য অথচ দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ কোনো প্রযুক্তি এখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন করেনি।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, নতুন কোনো ওষুধ বা টিকা না আসা পর্যন্ত এই নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই চলতে হবে। এর আগপর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন সবাই।