বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের প্রধান তিনটি কারণ
তীব্র লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ দেশের মানুষ। শহরের মানুষ বিদ্যুৎ পেলেও গ্রামগুলোতে ১২ ঘণ্টার বেশিও লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন কমেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে। একইসঙ্গে জ্বালানির আমদানি নির্ভর এ খাতে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছে সরকারের বকেয়াও বাড়ছে। ফলে চাহিদা মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না।
তীব্র লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ দেশের মানুষ। শহরের মানুষ বিদ্যুৎ পেলেও গ্রামগুলোতে ১২ ঘণ্টার বেশিও লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন কমেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে। একইসঙ্গে জ্বালানির আমদানি নির্ভর এ খাতে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছে সরকারের বকেয়াও বাড়ছে। ফলে চাহিদা মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, একটি দেশের মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার যত বাড়বে, সেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত বেশি হবে। ২০২০-২১ অর্থবছরের পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশে মোট বিদ্যুতের ৫৬ শতাংশ বাসাবাড়িতে, ২৮ শতাংশ শিল্পে, ২ শতাংশ কৃষিতে ও ১২ শতাংশ ব্যবহার হয় বাণিজ্যিক খাতে।
বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, দেশে প্রতিদিন বিদ্যুৎ চাহিদা স্বাভাবিক সময়ে সাড়ে ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট, তবে চলতি বছরে দাবদাহের কারণে চাহিদা তৈরি হয় ১৬ থেকে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এই সময়ে প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৩-১৪ হাজার মেগাওয়াট। ঘাটতি থেকেছে আড়াই হাজার মেগাওয়াটের বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশকে মূলত প্রাকৃতিক গ্যাস, জ্বালানি তেল, কয়লা ও সোলার এনার্জির ওপর নির্ভর করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট বিদ্যুতের ৫১ শতাংশ উৎপাদন হয় প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে, ২৬ শতাংশ উৎপাদন হয় ফার্নেস অয়েল থেকে ও বাকি অংশ উৎপাদন হয় অন্যান্য উৎস থেকে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য জ্বালানি হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। একসময় বাংলাদেশের বিদ্যুতের ৮০ শতাংশ উৎপাদন হতো প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে, বর্তমানে তা কমে ৫১ শতাংশে নেমেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ পেট্রোবাংলা নতুন কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে পারেনি এবং নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস- এলএনজি) বাংলাদেশে ব্যবহার হয়। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য দুই থেকে চার গুণ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট তৈরি হয়েছে। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন সে তুলনায় বাড়েনি।
বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে ২০০৯ সালে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এসব কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ চার-পাঁচ গুণ বেশি। বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন কেন্দ্রগুলো অনেক আগেই চালু করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সেগুলো চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে আমরা রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের ওপরই নির্ভরশীল রয়ে গেছি এবং রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও সহস্র কোটি টাকা তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে প্রদান করতে হচ্ছে। ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জনগণের করের টাকা অপচয় হচ্ছে এবং অন্যদিকে আমরা পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকটের প্রভাব কৃষি ও শিল্প সেবাসহ জনজীবনে বিরূপ প্রভাব তৈরি করেছে। বিদ্যুতের অভাবে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকায় এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের অভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মালিকরা। যেমন সরেজমিন তথ্য নিয়ে দেখা গেছে সাতদিনের মধ্যে দুইদিন একটি স’ মিলে বিদ্যুৎ বন্ধ থাকলে শ্রমিকদের খরচ বাবদ প্রতিদিন ৪ হাজার টাকা পারিশ্রমিক দিতে হয়, যদিও সেদিন মালিকের কোনো আয় হয়নি। এভাবে মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা শ্রমিকের পারিশ্রমিক বাবদ প্রদান করতে হয় কোনো আয় ছাড়া। এ অবস্থা চলতে থাকলে মালিককে স’ মিল বন্ধ করতে হবে। এভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে পড়লে বেকারত্ব সমস্যা আরো বাড়বে।
বিদ্যুৎ সংকট একই সঙ্গে চিকিৎসাসেবারও ক্ষতি করছে। বিশেষত অপারেশন করার সময় লোডশেডিং হলে রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। তাছাড়া অনেক মুর্মূষু রোগী আইসিইউ ও সিসিইউতে থাকে লোডশেডিং তাদের জীবন বিপন্ন করতে পারে। এভাবে হাসপাতালে হাজার হাজার রোগীর জীবন সংকটাপন্ন করতে পারে লোডশেডিং। কৃষি খাতে সেচের জন্যও বিদ্যুৎ প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে জমি সেচ দিতে না পারলে খাদ্য উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করবে, যা খাদ্য সরবরাহ কমিয়ে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়াবে।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক। বিদ্যুতের অভাবে অনেক তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ থাকে। ফলে কারখানা মালিকরা সময়মতো তৈরি পোশাক শিপমেন্ট দিতে সক্ষম হচ্ছেন না।ফলে বিদেশী ক্রেতাদের অর্ডার হারাতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিদেশী ক্রেতারা শ্রীলংকার মতো বিকল্প দেশগুলো থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করতে আগ্রহী হবেন। বিদ্যুতের এরূপ সংকট চলতে থাকলে আমাদের জিডিপি কমে যাবে এবং চরম বেকারত্ব দেখা দেবে। অতএব বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশের পর্যাপ্ত পরিমাণ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস রয়েছে। এ নবায়নযোগ্য জ্বালানি যেমন বৈদ্যুতিক শক্তি বা সোলার পাওয়ার, বায়ুশক্তি, জলশক্তি, বায়োগ্যাস ও বায়োম্যাস ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। এসব নবায়নযোগ্য শক্তি হচ্ছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সম্ভাব্য বিকল্প সমাধান। যদিও নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির উচ্চবিনিয়োগ খরচ একটি সীমাবদ্ধতা। তবু এ প্রযুক্তির দিকে অগ্রসর হতে হবে। এসব প্রযুক্তি উন্নয়নে ও এদের ব্যবহার প্রসারণে গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং গবেষকদের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা দিতে হবে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যা সোলার এনার্জি বা সৌরশক্তি আংশিক সমাধান করতে পারে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান সৌরশক্তি সঞ্চয়ের জন্য একটি আদর্শ অবস্থান। সোলার প্রযুক্তির মূল্য ও ইনস্টলমেন্ট খরচ এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত প্রতি বর্গমিটারে ৪-৫ কিলোওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
বাংলাদেশে অনেক উঁচুভূমি, দ্বীপ ও ৭ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সমুদ্রসৈকত রয়েছে। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে মাসে প্রতি সেকেন্ডে তিন থেকে ছয় মাইল বেগে বাতাস প্রবাহিত হয়। উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে কুয়াকাটা, সন্দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন, পতেঙ্গা, ভোলা, বরগুনা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়ে, ওয়াইন্ড এনার্জি-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করতে হবে।
হাইড্রো পাওয়ার একটি বিকল্প শক্তি, যা পানির স্রোত ও উচ্চতা থেকে আসে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর অনেক ক্যানেল জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। সম্প্রতি চট্টগ্রামে বামেরছড়া জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চালু করা হয়। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ পাওয়ার উন্নয়ন বোর্ড ১৯৮১ সালে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সম্ভাব্য এলাকা চিহ্নিত করেছে, সেগুলোয় অতিদ্রুত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করা প্রয়োজন।
বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের জন্য পেট্রোবাংলার উচিত অতিদ্রুত গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করা এবং গ্যাসভিত্তিক যে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আছে, সেগুলোকে সচল করা। অবশ্য নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের আগে গ্যাসভিত্তিক উৎপাদন কেন্দ্রগুলো চালু করা ঠিক হবে না। কারণ সেক্ষেত্রে গ্যাস সরবরাহ না করতে পারলেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে প্রচুর অর্থ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে পরিশোধ করতে হবে।
আমরা জানি মাথাপিছু বিদ্যুৎ ভোগ (পার ক্যাপিটা ইলেকট্রিসিটি কনজামপশন) যত বেশি হবে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত বেশি হবে। অতএব, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো ও বিদ্যুৎ খাতে সব অব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই।
What's Your Reaction?












